ধর্ম::হাদীসে বলা হয়েছে— “যে বছর প্রথম রমজান শুক্রবার দিয়ে শুরু হবে এবং ১৫ রমজানও শুক্রবার পড়বে। এবং ১৫ রমজানে ফজরের পর বিকট শব্দে অর্ধেক মানুষ প্রান হারাবে।”
প্রশ্ন হলো; এই হাদিসটি কি শুধুমাত্র বাংলাদেশের উপরে নাজিল করা হয়েছে?
যদি ক্যালেন্ডার গণনা করি তাহলে তারিখ ও দিন ঘুরে অনেকবারই রমজান মাসের প্রথম ১তারিখে শুক্রবারে আসতেই পারে। পরের দুই সপ্তাহের মাথায় আবার ঘুরে ঘুরে শুক্রবারই আসে। (এটাকে অলৌকিক বলা যায়না)।
জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি এদেশের মুসলিম বিশেষজ্ঞরা সৌদির উপর নির্ভর করে আসছে। সৌদিতে আজকে চাঁদ দেখা গেছে মানে আগামীকাল আমাদের দেশেও দেখা যাবে। সৌদিতে আজকে ঈদ মানে অটোমেটিক কালকে আমাদের দেশে ঈদ।
এখন কথা হইলো; সৌদি আরব যেহেতু আমাদের থেকে সব দিক দিয়ে ১দিন অগ্রিম, সেহেতু আগামীকাল শুক্রবার আমরাও পুরোপুরি নিরাপদ। কেননা সৌদি আরবে আগামীকাল শুক্রবার, ১৬ই রমজান অতিক্রম করে ফেলবে। এখন কথা হইলো ১৫তম রমজান, দিন শুক্রবার যেহেতু আমাদের ভাগ্যেই বর্তায় সেহেতু আমাদের দেশ ধ্বংস হবে আর সৌদি আরবের লোকেরা এই দৃশ্য দেখে সেজদায় পড়ে যাবে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশী সৌদি প্রবাসীরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবে।
“আমরা বাঁশের পানি খাওয়া জাতি”— চাঁদের নিচে নুকতা খুজি, চাদের মধ্যে ইমাম মাহাদিরে খুজি, কেয়ামতের আলামত খুজি, অথচ আমরা কখনও নিজেদের সংশোধন করার কথা ভাবিনা। মুনাফেকি, চোগলখোরি, বাটপারী, লুচ্চামি বেঈমানী স্বভাবকে সংশোধন করার কথা কখনও ভাবিনা।
ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের আলামতসংক্রান্ত এক হাদিসে এসেছে, কোনো এক জুমাবার হবে ১৫ রমজানে। সেদিন আকাশে বিকট আওয়াজ হবে। হাদিসটি হলো—ফিরোজ দায়লামি বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কোনো এক রমজানে আওয়াজ আসবে’। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের শুরুতে নাকি মাঝামাঝি সময়ে? নাকি শেষ দিকে?’ নবীজি (স.) বললেন, ‘না, বরং রমজানের মাঝামাঝি সময়ে। ঠিক মধ্য রমজানের রাতে। শুক্রবার রাতে আকাশ থেকে একটি শব্দ আসবে। সেই শব্দের প্রচণ্ডতায় ৭০ হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে যাবে আর ৭০ হাজার বধির হয়ে যাবে।’
উল্লেখিত বর্ণনাটি সহিহ নয়। বরং বিজ্ঞ হাদিস বিশারদরা এটিকে অত্যন্ত দুর্বল হিসেবে এবং অনেকে বাতিল ও বানোয়াট হাদিস বলে চিহ্নিত করেছেন। এই হাদিসের শেষের দিকে আছে, সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারা সেদিন নিরাপদ থাকবে? নবীজি (স.) বললেন, ‘যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থানরত থাকবে, সেজদায় লুটিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং উচ্চৈঃস্বরে আল্লাহু আকবর বলবে। পরে আরও একটি শব্দ আসবে। প্রথম শব্দটি হবে জিব্রাইলের, দ্বিতীয়টি হবে শয়তানের।
দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত ঘটনার পরম্পরা অনুযায়ী, শব্দ আসবে রমজানে। ঘোরতর যুদ্ধ সংঘটিত হবে শাওয়ালে। আরবের গোত্রগুলো বিদ্রোহ করবে জিলকদ মাসে। হাজি লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটবে জিলহজ মাসে। আর মুহররমের শুরুটা আমার উম্মতের জন্য বিপদ, শেষটা মুক্তি। সেদিন মুসলমান যে বাহনে চড়ে মুক্তি লাভ করবে, সেটি তার কাছে এক লাখ মূল্যের বিনোদন সামগ্রীতে পরিপূর্ণ ঘরের চেয়েও বেশি উত্তম বলে বিবেচিত হবে।’ (আল মুজামুল কাবির লিত তবারানি: ১৮/৩৩২/৮৫৩)
এই হাদিস সম্পর্কে শাইখ আলবানি (রহ) বলেন, হাদিসটি موضوع তথা বানোয়াট। ইবনুল জাওজি তার মাউজুআত তথা বানোয়াট হাদিস সংকলন গ্রন্থে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। (৩/১৯১)ইমাম জাহাবি বলেন, হাদিসটি বাতিল। (তারতিবুল মাউজুআত: ২৭৮) হাইসামি বলেন, এই হাদিসের বর্ণনা সূত্রে আব্দুল ওহাব ইবনুজ জাহহাক নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে মুহাদ্দিসিনদের দৃষ্টিতে মাতরুক বা পরিত্যাজ্য। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৭/৩১৩)ইমাম ইবনুল কাইয়িম বলেন, ‘অগ্রিম তারিখ নির্ধারণ করে বিভিন্ন ঘটনার বেশ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। সেগুলো সহিহ নয়।’ এর মধ্যে একটি হলো—‘অর্ধ রমজানের জুমার রাতে একটি আওয়াজ হবে। এতে ৭০ হাজার মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে.. ৭০ হাজার মানুষ বোবা হয়ে যাবে..।’ (আল মানারুল মুনিফ: ৯৬ পৃষ্ঠা)
সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো— আল্লাহর রাসুল (স.)-এর হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা এবং মিথ্যা, বানোয়াট বা অশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হাদিস প্রচার থেকে সাবধান হওয়া। কেননা বানোয়াট, জাল-জয়িফ হাদিস দিয়ে ইসলামের লাভ-ক্ষতি কিছুই হয় না, বরং নিজের বড় ক্ষতি হয়। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, যে ব্যক্তি জেনেশুনে রাসুল (স.)-এর নামে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করে তার পরিণাম হয় জাহান্নাম। (বুখারি, আস-সহিহ ১/৫২; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারি ১/১৯৯, মুসলিম, আস-সহিহ: ১/৯)
সুতরাং দলিলযোগ্য নয় এমন বর্ণনা প্রচার করা থেকে সাবধান থাকতে হবে। কেয়ামতের আলামত সম্বলিত অনেক সহিহ হাদিস আছে। যথাসম্ভব ওসব হাদিস নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন, সবসময় হক কথা বলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply