শামিউল হক শামীম, তাড়াশ প্রতিনিধি:
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) প্রায় ১০ কিলোমিটার জিসি সড়ক সংষ্কার প্রকল্পের বেশ কিছু অংশে কাজ না করেই সব বিল কৌশলে তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসের সাথে চলছে রশি টানাটানি। উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় বাস্তবতাকৃত কাজের বাইরে বিল দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর, ঠিকাদার সাংবাদিকতার মতো পেশা দিয়ে তাদের কে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজ না করে বিল চাওয়া প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সরোয়ার জাহান এন্টারপ্রাইজের পক্ষ থেকে জানানো হয়,তার লাইসেন্স ব্যবহার করে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছেন সিরাজগঞ্জের ঠিকাদার মো: মাহবুব আলম খাঁন। এ কারণে এ কাজের অনিয়ম বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের(এলজিইডি) আওতায় বন্যা ও দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ পল্লি সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন (এফ ডি ডি আর আই আর পি) প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার পৌর সদরের খুঁটিগাছা আরএইচডি হতে নওগাঁ বাজার পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার জিসি সড়ক সংষ্কারের কার্যাদেশ পায় মেসার্স সরোয়ার জাহান এন্টারপ্রাইজ। যার চুক্তি মূল্য ধরা হয় ছয় কোটি ২৩ লাখ টাকা।
মূল প্রাক্কলনের সিডিউলে থাকা কিছু আইটেম বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজন না থাকায়, সরকারি অর্থ অপচয় রোধে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ সে গুলো বাস্তবায়ন করা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। এ নিয়ে এলজিইডির ঢাকা ও পাবনা অফিসের দুটি তদন্ত কমিটি প্রকল্প পরিদর্শন করে সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, অসমাপ্ত কাজের মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সিডিউলে থাকা ৯৬ মিটার প্যালাসাইডিং, দুটি গাইডওয়াল,দুশটি গাইড পোস্ট ও প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা কার্পের্টিংয়ের কাজ সম্পন্ন না করা সত্তে¡ও কৌশলে চুক্তি মূল্যের ৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা বিল তুলে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন।
কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সিডিউলে থাকা ৯৬ মিটার প্যালাসাইডিং, দুটি গাইডওয়াল, দুইশ টি গাইড পোস্ট ও প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা কার্পেটিংয়ের কাজ যেহেতু সম্পন্ন করেননি, সেহেতু তারা কাজের অতিরিক্ত বিল পেতে পারেন না।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, অসামাপ্ত কাজের মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। কিন্তু তারপরও কাজ না করেই কৌশলে চুক্তিমূল্যের ছয় কোটি ২৩ লাখ টাকার বিল তুলে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। সমুদয় বিল তুলে নিলে সরকারের লোকসান হবে প্রায় ২০ লাখ টাকা।
উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় ও এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা গেছে, খুঁটিগাছা মহিষলুটি ভায়া নওগাঁহাট রাস্তাটি তাড়াশ উপজেলার সবচেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ । এ রাস্তার প্রায় মাঝ বরাবর দিয়ে চলে গেছে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক। ঢাকা বা রাজশাহী থেকে আগত এ অঞ্চলের যাত্রীরা এ রাস্তা ধরে চলাচল করে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন সংষ্কার না হওয়ায় উল্লেখিত সড়কটির বিভিন্ন স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়। খানাখন্দে যান চলাচলে প্রায় অনুপোযোগি হয়ে পরে। প্রায়শই ঘটতে থাকে নানা দুর্ঘটনা।
রাস্তাটি সংষ্কারের জন্য ২০২০-২১ অর্থ বছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে বন্যা ও দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ পল্লি সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন (এফ ডি ডি আর আই আর পি) প্রকল্পের আওতায় একটি দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ প্রকাশ করলে কার্যাদেশ পায় ঢাকার মেসার্স ডলি কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। দরপত্রে উল্লেখ ছিল মূল রাস্তা ১২ ফিট সংষ্কারের পাশাপাশি দুপাশে প্রশস্ত করণ হবে ০.৯ ও ০.৯ ফিট। কার্যাদেশ পাওয়ার পর সে সময়কার ডলি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ঠিকাদার হার্ডসোল্ডালের কাজ গায়েব করে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যায়।
পরবর্তীতে ২০২১-২২ অর্থ বছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বন্যা ও দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ পল্লি সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন (এফ ডি ডি আর আই আর পি) প্রকল্পের আওতায় পুণরায় ওই রাস্তার সংষ্কারের জন্য আবারও দরপত্র আহবান করা হয়। প্রকল্প গ্রহণ করে ছয় কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রাক্কলন তৈরি করা হয়।
ছয় কোটি ২৩ লাখ টাকার সর্বোনি¤œ দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পান নেত্রকোনার মদন উপজেলার ঠিকাদার মো: সরোয়ার জাহানের মেসার্স সরোয়ার জাহান এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি কার্যাদেশ দেয়া হয়। ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারা প্রকল্পের কাজ শেষ করেন। পরবর্তীতে বিলের আবেদন করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। তবে ঠিকাদার মো: সরোয়ার জাহান মুঠোফোনে বলেন, তার লাইসেন্স হলেও ব্যবহার করেছেন সিরাজগঞ্জের ঠিকাদার ও বিজনেস বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মো: মাহবুব আলম খাঁন। এ কারণে কাজের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
সিরাজগঞ্জের ঠিকাদার মো: মাহবুব আলম খাঁনের কাছে প্রকল্পের কিছু অংশের কাজ না করে অতিরিক্ত বিলের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চওয়া হলে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ কারণে এ বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না।
এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,ওই প্রকল্পের যাবতীয় তদারকি, মালামাল সরবরাহ ও বিল প্রস্তুতের সমস্ত কাজ করেছেন মাহবুব আলম খাঁন। এবং এলজিইডি কর্র্তৃপক্ষকে তার পেশা সহ বিভিন্ন ভাবে চাপ প্রয়োগ করছেন বিল ছেড়ে দেয়ার জন্য। এ সংক্রান্ত উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো একটি গোপনীয় প্রতিবেদন কালেরকণ্ঠের হাতে এসেছে।
তবে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছেন, ঠিকাদারের লোকজন কাজ না করেই অতিরিক্ত বিলের জন্য বিভিন্নভাবে হয়রানি ও চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। কিন্ত তারা এ চাপের কাছে নতী স্কীকার না করে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ কে জানালে, তারা দুটি টিম তদন্ত করে ঘটনা সত্যতা পেয়ে স্কিম রিভাইজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নওগাঁ বাজারের বাসিন্দা জাকির হোসেন রনি বলেন, কাজের ব্যবহৃত উপকরণও ছিল নিম্নমানের। যার ফলে কিছু দিন যেতে না যেতেই দেখা যাবে দুপাশে দেবে যাচ্ছে।
বিরোইল গ্রামের বাসিন্দা মি. রুবেল বলেন, নওগাঁ বাজার এলাকায় কোনো ইউ ড্রেন নির্মাণ হয়নি। কাজ না করেই বিল তুলে নিলে সরকারের টাকা লোকসান হবে।
এলজিইডির তাড়াশ উপজেলা প্রকৌশলী মি. ফজলুর রহমানের কাছে প্রকল্পের ঘাপলা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তাড়াশ উপজেলায় তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। তবে প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে ঢাকা ও পাবনার এলজিইডির দুটি টিম তদন্ত করেছেন। তাদের নির্দেশনা মোতাবেক বিল দেয়া হবে।
সিরাজগঞ্জের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী সফিকুল ইসলাম বলেন, মূল প্রাক্কলনে ভুলবশত: খোয়ার পরিমান কম ছিল। পরবর্তীতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে একটি রি-কাস্ট প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। যা মূল প্রাক্কলনের ৩.৪৪% নিম্ন। মূল প্রক্কলনে দুটি ইউ ড্রেন ধরা ছিল। পরিদর্শন করে দেখা যায় তা ভাল রয়েছে। এ কারণে নতুন করে আর নির্মাণ করার প্রয়োজন নেই। একইভাবে ৯৬ মিটার প্যালাসাইডিং মূল প্রাক্কলনে ধরা থাকলেও রি-কাস্ট প্রাক্কলে তা বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ণিত কাজ গুলো না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল তোলা অপচেষ্টা করে চলেছেন।
Leave a Reply